আদিবাসী নারী ধর্ষণের শাস্তি – কতদূর!!

মতামত

ইমতিয়াজ মাহমুদ

প্রতিবাদ করতে করতে একদিন আমরা ক্লান্ত হয়ে যাব, কিন্তু পাহাড়ে বাঙালি সেটেলাররা পাহাড়ি নারী ধর্ষণে কোনদিন বিরত হবে না। কেন হবে না? বলছি। প্রথমত, আদিবাসী নারী ধর্ষণের অপরাধে আজ পর্যন্ত কোন সেটেলার বাঙালীর শাস্তি হয়েছে? আমার জানা নেই। যদি দুই একটা হয়েও থাকে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যার তুলনায় তাঁর সংখ্যা এত নগণ্য এত নগণ্য যে সেগুলি আপনি উপেক্ষা করতে পারেন। (আবার বলছি, আমার জানামতে আদিবাসী নারী ধর্ষণের অপরাধে কোন সেটেলারের বা কোন বাহিনীর কোন সদস্যের কোন শাস্তি হয়নি আজ পর্যন্ত। অনেক ঘটনায় তো মামলাও হয়না।) তাইলে সাধারণের মনে ধারনাটা কি হয়? প্রচলিত বিশ্বাসটা কি দাঁড়ায়? বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই যে, পাহাড়ে সেটেলারদের মধ্যে এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা নিরাপত্তা বাহিনী বা যতরকম বাহিনী আছে সকলের মনে এইটাই দৃঢ়ভাবে বিরাজ করে যে পাহাড়ি মেয়েদেরকে ধর্ষণ করে ফেললে কোনরকম শাস্তি হবে না। আমি জানি যে সমতলেও এরকম হয়। এখানেও ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহংসতার বিচার ও সাজার হার খুব ভাল না। কিন্তু তবুও তো এখানে বিচার হয়। পুলিশ গ্রেফতার করে, হাজতে থাকতে হয় কিছুদিন- আর কোন কোন ক্ষেত্রে সাজাও হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা, ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া এটাই তো আমাদের সমতলে একটা বড় কলঙ্কের ব্যাপার। পাড়া প্রতিবেশী নিন্দা করে, পিতামাতার মুখ কালো হয়, বোনের শ্বশুরবাড়িতে মন্দ কথা বলে- এইরকম। কিন্তু পাহাড়ে ধর্ষণকে সেটেলারদের মধ্যে একটা জাতিগত রাজনৈতিক ব্যাপার হিসাবেই দেখা হয়।

একজন সেটেলার যখন একটি আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণ করে, সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বা মামলা করলে গোটা সেটেলার সমাজ এক হয়ে ছেলেটাকে ডিফেন্ড করতে থাকে। এরা তখন ভাল মন্দ যুক্তি কুযুক্তি নানারকম কথা মিশিয়ে এমন একটা ধুম্রজাল তৈরি করে যেন বিচারটা আর না হয়। আর এইসব ক্ষেত্রে সেটেলারদের সাথে যোগ দেয় পুরো বেসামরিক প্রশাসন, আর সকল বাহিনী। ভিক্টিমের পিতামাতাকে ধরে আনা হয়, সামাজিকভাবে প্রচার প্রচারণা চালানো হয়- কিছুটা চাপ কিছুটা ধমক কিছুটা মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যাবস্থা নেওয়া হয় যেন ধর্ষকের বিরুদ্ধে কেউ কিছু না বলে। আপনারা এইরকম ঘটনার উদাহরণ চাইলে পাহাড়ে বাস করে এমন কাউকে জিজ্ঞাসা করেন, অসংখ্য উদাহরণ পাবেন। জিয়াউর রহমানের সময় থেকে পাহাড়ে যাদেরকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে, সেইসব পুনর্বাসিত বাঙালী বা সেটেলার, ওদের বংশধর আর সেখানকার প্রশাসন সকলের মধ্যেই এই মূল্যবোধটা বিকশিত হয়েছে যে বাঙালীরা মাঝে মাঝে পাহাড়ি মেয়েদেরকে উত্যক্ত করবে, ধর্ষণ করবে- এটা সেরকম দোষের কিছু না। এ যেন অনেকটা পাশের বাড়ীর গাছ থেকে কাঁচা আম চুরি করা- একটু আধটু দুষ্টুমি। তাইলে আমাকে বলেন, পাহাড়ে সেটেলারদের হাতে পাহাড়ি নারী নির্যাতন বন্ধ হবে? হবে না। আপনি আমি এইখানে ঢাকা শহরে বসে প্রতিবাদ করতে পারি। আমি আমার আবেগের কথা ক্রোধের কথা ফেসবুকে লিখতে পারি- সে আবেগ হয়তো আপনাকেও স্পর্শ করবে- কিন্তু সেটেলার বীরপুরুষরা পাহাড়ি নারী ধর্ষণ বন্ধ করবে না।

এই যে সেদিন খাগড়াছড়িতে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সী একটা মেয়েকে ওর দেয়ালঘেরা বাড়ীর গেট ডিঙিয়ে ঘরের দরোজা ভেঙে নয় দশজন সেটেলার বাঙালী বীরপুরুষ ধর্ষণ করে গেছে, আপনার কি মনে হয় ওদের কোন বিচার হবে? হবে না। সেটা ঐ বীর বাঙালী সেটেলাররাও জানে। জানে বলেই ঐরকম একটা কাণ্ড ঘটানোর সাহস ওদের হয়েছে। গতরাতে আগের রাতের ঘটনা এটা। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে নয় দশজন সেটেলার ১ নং গোলাবাড়ি ইউনিয়ন সংলগ্ন বলপেইয়া আদামের একটি বাড়িতে এই ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষিতার মা আহত হয়েছে, ধর্ষিতাকে পরের দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেটেলারগুলিকে সনাক্ত করা না গেলেও ভিক্টিম জানিয়েছে যে ওদেরকে দেখলে তিনি চিনতে পারবেন- ওরা সম্ভবত পাশের গ্রাম গঞ্জপাড়া থেকে এসেছিল। এই যে গঞ্জপাড়া গ্রামটা, এটা চলল একসময় একটা মারমা গ্রাম, গ্রামের বেশীরভাগই মারমা। এখন সেই গরমাকে আর মারমা গ্রাম বলা যাবে না- সেটা হয়ে গেছে একটা সেটেলার গ্রাম। দুই চার ঘর মারমা এখনো আছে বটে, বাকি সব মারমা পরিবার আর ওখানে থাকতে পারেনি। এইসব ঘটনা যখনই ঘটে, খবর পেলে মনটা ছোট হয়ে যায়, নিজেকে অসহায় লাগে। ক্রোধ হয়- প্রতিবাদ করি। কখনো কখনো আমরা রাস্তায়ও নেমেছি। কিন্তু ফলাফল কি? আদিবাসী নারী নির্যাতন বন্ধ হয়েছে? হবে বলে মনে হয়? হবে না। এইভাবে হবে না।

দেখেন, আমরা এই দেশে সংখ্যালঘু। চাকমারা সংখ্যালঘু, মারমা ত্রিপুরা লুসাই বম ওরা সবাই সংখ্যালঘু, সেক্যুলার লিবারেল লেফট হিউম্যানিস্ট ফেমিনিস্ট সবাই সংখ্যালঘু। আমরা যখনই চীৎকার চ্যাঁচামেচি করি, সংখ্যাগুরু মুসলিম মুসলমান বাঙালীরা ওরা একটু বিরক্ত হয়, ওদের কেউ কেউ একটু বিব্রতও হয় বটে- হাজার হোক প্রতিবাদটা যে ন্যায্য সেকথা তো আর অস্বীকার করতে পারে না আরকি। কিন্তু আখেরে কোন ফল হয় না। কেননা আপনাদের বেশিরভাগই মনের গভীরে ঐ ধর্ষকদের ভাই বন্ধু পিতা মাতা চাচা মামা খালা খালু। আপনাদের মধ্যে যারা খুব ভালো মানুষ, ওরা হয়তো মুখে একটু বলবেন যে না, এইসব ঘটনার তো বিচার হওয়া দরকার- ব্যাস ঐ পর্যন্তই। আপনারা কখনো বলবেন না যে আদিবাসীদের জাতিগত অধিকার স্বীকার করবেন না, আপনারা ওদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করবেন না। এইসব ঘটনা শুধুমাত্র নারী নির্যাতনের ঘটনা নয়। এইরকম প্রতিটা ঘটনা জাতিগত নির্যাতনের একেকটা উদাহরণ। আপনি যতদিন পর্যন্ত না আদিবাসীদের জাতিগত অধিকার স্বীকার না করবেন, যতদিন পর্যন্ত না ওদের ভূমিতে ওদের অধিকার মেনে না নিবেন, যতদিন পর্যন্ত আপনি আদিবাসীদের সাথে নিজের জাত্যাভিমান দেখানো বন্ধ না করবেন- এইসব ঘটনার বিচার হবে না, এইসব ঘটনার বন্ধ হবে না। শোনেন, এইসব অত্যাচারের মূল্য দিতে হবে আমাদের সবাইকে। আজ আমার খাগড়াছড়ির এই বোন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তার কদিন আগে এক পুলিশের হাতে আরে আরেক আদিবাসী ছাত্রী নির্যাতিতা হয়েছে- প্রতিদিন এরকম ঘটনা ঘটছে। এসবের দায় আমাদের পুরো জাতির। একটা কথা আছে, ধর্ষণ করতেও একটা পুরো গ্রাম লাগে আর ধর্ষণের ঘটনা চাপা দিতেও পুরো গ্রাম লাগে। মানে হচ্ছে যে পুরো কমিউনিটির সমর্থন না থাকলে ধর্ষণও হয়না ধর্ষণের ঘটনা চাপাও দেওয়া যায় না। পাহাড়ে সেটেলাররা যে এইসব অত্যাচার করছে, এইটা ওরা করতে পারছে কারণ আপনি ওদের সাথে আছেন, আপনার কমিউনিটি ওদের সাথে আছে, আপনার রাষ্ট্র ওদের সাথে আছে।

এর মূল্য আপনাদেরকে দিতে হবে। আমি বলে দিলাম, আসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস কান্না ও আর্তচীৎকার কোন ফালতু বিষয় নয়- অনেক বড় মূল্য দিবেন আপনারা, দেখবেন। আমাদের মেয়েদের উপর যারা অত্যাচার করছে ওদের বিচার করবেন না? শাস্তি আপনাদের সকলেরই হবে একদিন দেখবেন। আপনাদের কাছে আমি বিচার আর চাই না- আমি দিন গুনছি আপনাদের শাস্তি দেখবো বলে। ইতিহাস যদি আমি ঠিকমত পড়ে থাকি, শাস্তি আপনাদের হবেই। মনে রাখবেন।

সোর্সঃ লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল।

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10224230850907364&id=1485282836

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

Tags: , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

বাঘাইছড়িতে জেএসএস এর থানা কাউন্সিল সম্পন্ন।
মানুষকে বেশিদিন ইল্যুশনে বেঁধে রাখা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu